টাইটানিক: বিলাসিতা থেকে বিপর্যয় পর্যন্ত এক ইতিহাস
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ এবং আলোচিত জাহাজ ছিল টাইটানিক। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল, সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে এই জাহাজটি একটি বিশাল আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের অতলে তলিয়ে যায়। এই ঘটনাটি আজও মানুষের মনে শোক ও কৌতূহল জাগিয়ে রাখে। কিন্তু কেন ডুবেছিল এই জাহাজটি?
বিলাসিতার এক বিস্ময়
ইংল্যান্ডের লিভারপুল ডকইয়ার্ডে নির্মিত টাইটানিক ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বিলাসবহুল জাহাজ। এতে ছিল উষ্ণ জলের সুইমিং পুল, অত্যাধুনিক জিমনেসিয়াম, দুটি পাঠাগার, টেনিস কোর্ট, এবং সুন্দর বাগান। এতসব সুবিধা দেখে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড অ্যান্ড ওলফ সাহস করে বলেছিল, “টাইটানিক কখনোই ডুববে না।”
৪৬ হাজার টনের এই বিশাল জাহাজের দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮২ ফুট ৬ ইঞ্চি, যা প্রায় তিনটি ফুটবল মাঠের সমান। ১৭৫ ফুট উঁচু এবং নয়টি ডেক সমৃদ্ধ এই জাহাজে একসঙ্গে ৩,৩৩৯ জন যাত্রী এবং তাদের মালামাল বহন করা সম্ভব ছিল।
জাহাজটি প্রথম ভাসানো হয় ১৯১১ সালের ৩১ মে। এ দৃশ্য দেখতে প্রায় এক লাখ মানুষ সমুদ্র তীরে ভিড় জমায়। এরপর ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে এটি নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
দুর্ঘটনার রাত
যাত্রার চতুর্থ দিন, ১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপের কাছে টাইটানিক একটি ভাসমান আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ৩০০ ফুট আয়তনের একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়, এবং পানিরোধক অনেক কামরা দ্রুত ভরে যায় পানিতে। মাত্র ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে জাহাজটি ডুবে যায়।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রায় ১,৫১৭ জন যাত্রী এবং ক্রু সদস্য ঠাণ্ডা পানিতে মারা যান। সমুদ্রের তাপমাত্রা তখন মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পুনরাবিষ্কার
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ৭৪ বছর পর, ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই, এটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের ১২,৬০০ ফুট গভীরে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এটি দুই টুকরো হয়ে প্রায় ১,৯৭০ ফুট দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সম্মুখভাগ সমুদ্রতলের ৬০ ফুট মাটির নিচে প্রোথিত ছিল।
কেন ডুবল টাইটানিক?
অনেকের মতে, টাইটানিক শুধু বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েই ডুবে যায়নি। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং জাহাজের বিলাসবহুল কাঠামোর ভারও এই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। জাহাজটির শক্ত কাঠামো হলেও, বরফখণ্ডের আঘাতে এর দুর্বলতাগুলো ফুটে ওঠে।
বিস্ময়কর পরিসংখ্যান
জাহাজটি নির্মাণে ৩,০০০ শ্রমিকের প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। এর নির্মাণব্যয় ছিল ৭.৫ মিলিয়ন ডলার। জাহাজটি ঘণ্টায় ২৭ মাইল গতিতে ছুটতে পারত, আর এর আলোকসজ্জার জন্য ১০,০০০ বাল্ব স্থাপন করা হয়েছিল।
যাত্রীদের জন্য বিশাল পরিমাণ খাবার মজুদ ছিল। যেমন:
- ৭৫ হাজার পাউন্ড মাংস
- ১১ হাজার পাউন্ড মাছ
- ৪০ হাজার ডিম
- ১৪ হাজার গ্যালন পানি
- ৪০ মেট্রিক টন আলু
- ৩৬ হাজার আপেল
টাইটানিকের নির্মাণ এবং এর করুণ পরিণতি মানব ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। বিলাসিতার স্বপ্নের মধ্যে বিপর্যয়ের এই কাহিনী আমাদের সবসময়ই সতর্কতার এক অনন্য শিক্ষা দেয়।
কোন মন্তব্য নেই