Header Ads

Header ADS

বিশ্ব ইজতেমা: বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশের অজানা গল্প

 


তাবলীগ জামাত সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তৃত একটি প্রভাবশালী ইসলামী আন্দোলন তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মিলন বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে ঢাকার তুরাগ নদীর তীরবর্তী এলাকা জুড়ে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করা হয়। এ ছারা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ মুসলিম বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। সে কারণে অনেকেই মনে করেন হজের পরে এটি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমেই তাবলীগ জামাত বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা কিভাবে শুরু হয়েছিল এবং বিশ্ব ইজতেমা কিভাবে আয়োজন করা হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে ১৯২০ এর দশকে মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস কাঞ্চন নেতৃত্বে তাবলীগ জামাত আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তারপর এই সংগঠনের কার্যক্রম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর ১৮০ থেকে প্রায় ২০০ টি দেশে তাবলীগের কার্যক্রম রয়েছে এবং আনুমানিক এক কোটি বিশ লক্ষ থেকে প্রায় ৮ কোটি লোক তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাবলীগ জামাতের সাথীদের একত্রিত হওয়ার জন্য প্রায়ই ইজতেমার আয়োজন করা হয়। অধিকাংশ ইজতেমা হয় বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশকে কেন্দ্র করে। সারা বিশ্বের তাবলীগের সাথীরা যাতে একত্রিত হতে পারেন সে জন্যই মূলত বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়।

বিশ্ব ইজতেমা শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। আরবি ইজতেমা শব্দের অর্থ সম্মিলন, সভা-সমাবেশ বা একত্রিত হওয়া। সাধারণত প্রতিবছর শীতকালের এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেজন্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস বেছে নেয়া হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম এবং শহর থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫৫ টি দেশের তাবলীগী মুসলমানদের জামাত এখানে একত্রিত হয়। ধারণা করা হয় ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। তাই একে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন হিসেবে দাবি করা হয়।

ইজতেমার কর্মকাণ্ড ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিপুল অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী এর জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ইজতেমার জনপ্রিয়তা তাবলীগ জামাতের উজ্জ্বল পরিচিতির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কের পাশে অবস্থিত কাকরাইল মসজিদ বাংলাদেশ তাবলীগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র ১৯৫২ সালে এই মসজিদটিকে বাংলাদেশের তাবলীগের মার্কাজ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে এখান থেকেই ইজতেমার সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ জামাতের বার্ষিক সম্মিলন বা প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা হয়েছিল। তখনকার সেই আয়োজন কেবল ইজতেমা হিসেবেই পরিচিত ছিল।

এরপর থেকে আবারো রমনার উদ্যানে ইজতেমা হতে থাকে প্রতি বছর ইস্তেমায় অংশগ্রহণকারী বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে রমনার বদলে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইজতেমায় অংশ নেন। ফলে সেটি বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে তখন থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরবর্তী ১৬০ একর জায়গা বিশাল খোলা মাঠে বিশ্বইজতেমা হয়ে আসছে। পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ। এখানে বাঁশের খুটির উপর চটের ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য মাঠ প্রস্তুত করা হয়। তবে বিদেশী মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে আগত মুসল্লিদের জন্য মাঠের বিভিন্ন অংশে ভাগ করা থাকে। সাধারণত তাবলীগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়োগ করেন। সে হিসেবে প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তাবলীগের সাথে জড়িত নন এমন অনেক মুসলমান শুধুমাত্র জুমার নামাজ আদায় করতে এবং আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে ইজতেমায় যোগ দেন। ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন শেষ হয়। তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে আখেরি মোনাজাত কে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় না। তবে একটি বিষয় প্রচলিত আছে যে, যত বেশি লোক একসাথে দোয়া করবে তত বেশি দোয়া কবুল হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই যারা তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত নন তারা এত বড় জামাতের বরকত লাভের আশায় আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়ে নিজেদের গুনাহ মাফের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। সে কারণে আখেরি মোনাজাতের আরো প্রায় কয়েক লক্ষ মুসলিম টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের আশেপাশের সমবেত হন। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং বিরোধীদলীয় নেতা সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লোকজনও আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাবলীগ জামাতের সদস্যদের অধিকাংশই রয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায়। সে কারণে এই অঞ্চলের সাথীরা ইজতেমায় সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেন। তবে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমার স্বাগতিকদের সবার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সমাবেশে যোগ দেন। প্রতি বছর ইস্তেমায় অংশগ্রহণকারী বাড়তে থাকায় কাকরাইল মারকাজ মসজিদ কর্তৃপক্ষ দুই ধাপে ইজতেমা করার এই সিদ্ধান্ত ২০১১ সালে কার্যকর হয়। তখন থেকে তিনদিন করে আলাদা আলাদা ভাবে মোট ৬ দিনেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজন করার পর মুসল্লিদের সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে। সে কারণে ২০১৭ সাল থেকে নির্বাচিত ৩২ টি জেলার মুসল্লিদের নিয়ে ইজতেমা আয়োজন করা হয়। বাকি ৩২ টি জেলার সাথীরা পরবর্তী বছরের ইজতেমায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।

তবে পরিচালনাগত সুবিধার বাইরে তাবলীগ জামাতের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিশ্ব ইজতেমায় বিভক্তি তৈরি হয়েছে। তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা সাদ কান্ধলভী বিতর্কিত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মারকাজ পন্থী এবং মাদ্রাসা পন্থী তাবলীগের দুটি পৃথক ধারা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের ভেতরেই দুই গ্রুপের সহিংসতা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে কাকরাইল মারকাজ মসজিদের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মাওলানা সাদ ইজতেমায় অংশ নেয়ার জন্য ঢাকায় আসলেও তাকে ইজতেমা ময়দানে যেতে দেওয়া হয়নি। এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ইজতেমা পূর্ববর্তী সমাবেশে তাবলীগ জামাতের দিল্লি মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী দুই পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সে কারণে পরের বছর ২০১৯ সালে ইজতেমা বন্ধ ছিল। এরপর ২০২০ সাল তাবলীগের দুইপক্ষ আলাদা আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করে আসছে। এরপর করণা মহামারীর কারণে পরপর দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা বন্ধ ছিল। ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আবারও দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ জন নিহতের ঘটনা ঘটে। মতের পার্থক্য থাকার কারণে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপ এখনও পর্যন্ত এক হতে পারেনি সে কারণে প্রতি বছর দুইগ্রুপ আলাদা আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করছে। তাবলীগের দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই দূর করা সম্ভব আর তিনি হলেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভী। মূলত তার বিতর্কিত বক্তব্যের জের ধরেই দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ পন্থী এবং মাদ্রাসা পন্থী তাবলীগের দুটি পৃথক ধারা সৃষ্টি হয়েছে। 


কোন মন্তব্য নেই

PLAINVIEW থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.