আজ আপনাদের নিয়ে
যাবো এমন এক বিস্ময়ের
রাজ্যে, যেখানে যেতে চায় পৃথিবীর
অসংখ্য মানুষ। নাম তার হিমালয়।
এর সৌন্দর্য, রহস্য আর ভয়ঙ্কর সৌকর্য—সব মিলিয়ে এক
মায়াজাল। যে একবার এর
কথা শুনেছে বা দেখেছে, সে
এর মোহ থেকে বেরোতে
পারেনি।
হিমালয় মানেই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের হাতছানি
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা, হিমালয়।
কিন্তু উঁচু মানেই তো
আর সহজে বোঝা যাবে
না! ভাবুন তো, ২০ বা
৫০ তলা ভবনের ছাদ
থেকে মানুষকে পিঁপড়ার মতো লাগে। তাহলে
আট কিলোমিটার উঁচু থেকে কী
দেখতে পাবেন? সেখানে হাতি-ঘোড়া তো
দূরের কথা, নীল তিমিও
টের পাবে না তার
অস্তিত্ব! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯ হাজার
৩৫ ফিট উঁচুতে অবস্থিত
হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট।
হিমালয় নামের অর্থ?
‘হিমালয়’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, যার
অর্থ "তুষারের বাসস্থান"। কারণ, এর
সর্বোচ্চ চূড়াগুলো সবসময় বরফে ঢাকা থাকে।
পাহাড় আর পর্বত—এদের
পার্থক্য বুঝতে পারছেন তো? পাহাড়ের চেয়ে
বড় আর উঁচু গুলোই
হলো পর্বত। আর যখন অনেকগুলো
পর্বত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তাকে বলা
হয় পর্বতমালা। হিমালয় হলো তেমনই এক
মহা-পর্বতমালা।
এই বিশাল পর্বতমালায়
আছে ৬৬টি পর্বত। ভারত,
নেপাল, ভূটান, চীন, পাকিস্তান—সব
মিলিয়ে এই পর্বতমালার বিস্তার।
এ যেন এক দৈত্যাকার
দেহ। এর মধ্যবর্তী অঞ্চলেই
রয়েছে নেপাল, ভূটান আর ভারতের সিকিম।
আর উত্তর-দক্ষিণে এর শাখা-প্রশাখা
ছড়িয়ে গেছে চীন, পাকিস্তান,
তিব্বত এবং আফগানিস্তানের দিকে।
হিমালয়ের গা বেয়ে বয়ে চলা প্রাণের ধারা
হিমালয় কেবল পর্বত নয়,
এ এক জীবনস্রোতের উৎস।
এখান থেকেই জন্ম নেয় অসংখ্য
নদী—যেগুলো ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার
সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে। এই
নদীগুলো বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগর
আর ভারত মহাসাগরে। আমাদের
বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিও আসে হিমালয়ের বরফ
গলে। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র—এই
দুই মহা-নদীর উৎস
হিমালয়ে। গঙ্গা বাংলাদেশে এসে হয়ে গেছে
পদ্মা। সেই নদীর বুকেই
আমাদের দেশ বেঁচে আছে,
বেড়ে উঠছে।
হিমালয়ের জন্মকথা
আজ থেকে প্রায় ৬
কোটি বছর আগে হিমালয়ের
জন্ম। তখনকার পৃথিবী তো আর আজকের
মতো ছিল না! বিশাল
ভূমিকম্প আর টেকটোনিক প্লেটের
সংঘর্ষ থেকে তৈরি হয়
এই পর্বতমালা। এখনো ভূমিকম্প হিমালয়কে
একটু একটু করে বদলে
চলেছে।
সবচেয়ে উঁচু চূড়াগুলো কোথায়?
হিমালয় পর্বতমালায় তিনটি সমান্তরাল সারি বা রেঞ্জ
আছে। দক্ষিণের রেঞ্জে সবচেয়ে ছোট চূড়া—উচ্চতা
৫ হাজার ফিট। মাঝের সারির
চূড়াগুলো ৭ হাজার থেকে
১৫ হাজার ফিট পর্যন্ত উঁচু।
আর সবচেয়ে উত্তরের রেঞ্জে রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সব চূড়া, যার
মধ্যে সবার উপরে মাউন্ট
এভারেস্ট।
মাউন্ট এভারেস্টের নামকরণে মজার গল্প
একসময় সবাই মনে করতো
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ হলো
কাঞ্চনজঙ্ঘা। পরে জানা যায়,
আসল চ্যাম্পিয়ন তো এভারেস্ট! এভারেস্টের
উচ্চতা প্রথম মাপেন এক বাঙালি—রাধানাথ
শিকদার, ১৮৫২ সালে। কিন্তু
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত সরকার ব্যাপারটা
যাচাই-বাছাই করতে সময় নেয়
বেশ কয়েক বছর। অবশেষে
১৮৬৬ সালে ঘোষণা করা
হয়—মাউন্ট এভারেস্টই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ।
কিন্তু শৃঙ্গটির নাম কী হবে?
স্থানীয় লোকেরা বিভিন্ন নামে ডাকতো—তিব্বতে
"চমোলুংমা" (পবিত্র মা) আর নেপালে
"সগরমাথা"। কিন্তু ব্রিটিশ
অফিসার অ্যান্ড্রু ওয়াহ বেছে নিলেন
তারই আগের বস—জর্জ
এভারেস্টের নাম। এইভাবেই এভারেস্ট
পেল তার আন্তর্জাতিক নাম।
মানুষের জয় আর পরাজয়ের গল্প
১৯৫৩ সালের ২৯ মে। ইতিহাসে
এক নতুন দিন। মানুষের
কাছে এতদিন যে শৃঙ্গ ছিল
অজেয়, সেই এভারেস্টের চূড়ায়
প্রথম পা রাখেন এডমন্ড
হিলারি আর তেনজিং নোরগে।
কিন্তু এতো উঁচুতে ওঠা
তো চাট্টিখানি কথা নয়! এভারেস্টে
বাতাসে অক্সিজেন খুবই কম। তাই
অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া উপরে ওঠা
প্রায় অসম্ভব। পথেই তো হাজারো
বিপদ—তুষারধ্বস, খাড়া বরফের দেয়াল
আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ভুল পথে পা
রাখলেই সব শেষ!
কিন্তু এসব ঝুঁকি নিয়েই
প্রতি বছর শত শত
মানুষ ছুটে যায় এভারেস্টের
চূড়ায় পা রাখতে। বাংলাদেশের
নামও যোগ হয়েছে এই
মহাযাত্রায়।
মুসা ইব্রাহিমের অবিস্মরণীয় অর্জন
২০১০ সালের ২৩ মে। প্রথমবারের
মতো বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে
উঁচু শৃঙ্গে—মাউন্ট এভারেস্টে। সেই ইতিহাস রচনা
করেন মুসা ইব্রাহিম। এরপর একে
একে আরো কয়েকজন বাংলাদেশি
এভারেস্ট জয় করেন। এম
এ মুহিত তো দু'বার
এভারেস্টে উঠেছেন। আর বাংলাদেশের নারীরা?
পিছিয়ে থাকেননি তাঁরাও! নিশাত মজুমদার ২০১২ সালের ১৯
মে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে জয়
করেন এভারেস্ট। পরে ওয়াসফিয়া নাজরীন দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে এই
অর্জন গর্বের সঙ্গে নিজের নামে লিখে নেন।
হিমালয়—এক স্বপ্নের নাম
হিমালয় শুধু একটি পর্বতমালা
নয়। এটি এক অবিনশ্বর
প্রেরণা। যারা এই শৃঙ্গ
জয় করতে পেরেছেন, তারা
কেবলই একটি পর্বত নয়,
বরং নিজের সীমাবদ্ধতাকেও জয় করেছেন। আর
যারা স্বপ্ন দেখেন, তারা জানেন—হিমালয়
ডাকছে তাদের।
সুন্দর
উত্তরমুছুন